প্রকাশিত: Wed, Jan 11, 2023 7:24 AM
আপডেট: Sun, Jun 29, 2025 7:35 AM

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব

২০৫০ সাল নাগাদ চরম পানি সংকটে পড়বে বিশে^র ৫০০ কোটি মানুষ, হুমকির মুখে খাদ্য নিরাপত্তা

এম. মোশাররফ হোসাইন

গত শতাব্দীতে বিশ^ব্যাপী জনসংখ্যা বৃদ্ধির তুলনায় কয়েক গুণ বেড়েছে পানির চাহিদা। কিন্তু চাহিদার তুলনায় পর্যাপ্ত পানি সরবরাহের অভাবে ব্যহত হচ্ছে কৃষি, যেটি আগামী শতকে মানুষের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। এভাবে সংকট ঘনীভূত হতে থাকলে শিগগিরই মানবজাতির জন্য অশুভ সময় ঘনিয়ে আসছে। জাতিসংঘের তথ্য বলছে, বিশ্বের প্রায় ২৩০ কোটি মানুষ সুপেয় পানির সংকট থাকা দেশগুলোতে বসবাস করছে। এমতাবস্থায় জলবায়ু সংকট আরও প্রবল হলে বৈশ্বিক সুপেয় পানির সংকট আরো বহু গুণে বেড়ে যাবে। জাতিসংঘ নিরাপদ পানি প্রাপ্তিকে মৌলিক অধিকার ঘোষণা করার পরও বিশে^র ৭৬ কোটি ৮০ লাখ মানুষ এ সুবিধা থেকে এখনো বঞ্চিত। ইউনিসেফ ও বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে নিরাপদ পানির সুবিধাবঞ্চিত মানুষের দুই-তৃতীয়াংশের বাস ১০ দেশে, যার মধ্যে চীন, ভারত, নাইজেরিয়া, ইথিওপিয়া, ইন্দোনেশিয়া, তানজানিয়া, পাকিস্তান, কেনিয়া ও বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য।

বিজ্ঞানীরা পানি সংকটের পেছনের প্রধান কারণ হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তনকে আখ্যায়িত করেছেন। যার ফলে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলো খরা, বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদিতে আক্রান্ত হয়, এসবের ফলে বিশুদ্ধ পানির উৎস নষ্ট হয়ে সংকট দেখা দেয়এবং বিভিন্ন পানিবাহিত রোগের ব্যাপক বিস্তার ঘটে। উপরন্তু, অতিরিক্ত খরার কারণে সাব-সাহারার আফ্রিকার ৮০ শতাংশ কৃষিজমি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে এবং সমুদ্রের লবণাক্ত পানির স্তর বৃদ্ধির ফলে, বিভিন্ন উৎসের পানি পানের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। টেকসই উন্নয়নে রয়েছে পানির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। ক্রমবর্ধমান পানির সংকট বিশ্বব্যাপী চরম অস্থিরতার জন্ম দিতে পারে। ল্যাটিন আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ায় পানির প্রবল ঘাটতি আঞ্চলিক সংঘাতকে উসকে দিচ্ছে। আমেরিকার ওয়াটার ওয়ার্কার্স অ্যাসোসিয়েশন (এডব্লিউডব্লিউএ) তাদের একটি গবেষণায় জানিয়েছে, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার সাম্প্রতিক অস্থিরতার পেছনে রয়েছে পানি সম্পদের বিপর্যয়। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও আধুনিক পানি ব্যবস্থাপনার অভাবে কৃষি খাতে বিপর্যয় নেমে এসেছে। পর্যাপ্ত পানি সরবরাহের অভাবে খাদ্য উৎপাদন কমে যাচ্ছে। হুমকির মুখে পড়েছে নাগরিক জীবন। দেখা দিচ্ছে প্রবল গণঅসন্তোষ। ২০১১ সালে মিসরে খাদ্য শস্যের উৎপাদনে ব্যাপক বিপর্যয়ের কারণে সরকারের বিরুদ্ধে যে গণজাগরণের সৃষ্টি হয়েছিল, তার কারণও ছিল এই পানি সংকট। ভবিষ্যতে মিসরের সঙ্গে ইথিওপিয়ার পানি নিয়ে যুদ্ধ বাধার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।  ভারতের পানির উৎসের তুলনায় চাহিদা অনেক বেশি। ভবিষ্যতে তা সংকটজনক পর্যায়ে চলে যেতে পারে। সীমান্ত সমস্যা ও ধর্মীয় বিরোধের বাইরে পানি নিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে যেতে পারে ভারত। ২০১৮ সালে ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ পানি সংকটের মুখোমুখি হয়েছিল ভারত। দেশটির সরকারি একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, ভারতের ১৩০ কোটি জনসংখ্যার অন্তত ৪০ শতাংশ মানুষের জন্য ২০৩০ সালের মধ্যে খাওয়ার পানির নির্ভরযোগ্য কোনো উৎসের সুযোগ থাকবে না। চীনেও রয়েছে পানির ব্যাপক সংকট। দেশটির উত্তরাঞ্চলীয় ভূগর্ভস্থ পানির ৭০ শতাংশই মানব স্বাস্থ্যের অনুপযোগী। আগামী ৪ থেকে ৫ বছরের মধ্যে চীনের প্রায় তিন কোটি মানুষ পানির অভাবে অভিবাসী হয়ে যেতে পারে। ভারত মহাসাগরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নয়াদিল্লির সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়তে পারে বেইজিং। ২০৩৫ সালে বিশ্বে পানির চাহিদা ৮৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। এত বিপুল চাহিদার জোগান নিয়ে আতঙ্কে আছে উন্নত বিশ্ব। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ফ্রান্স ও অস্ট্রেলিয়া তাদের জ্বালানি উৎপাদনে প্রয়োজনীয় পানির সংকটে পড়তে পারে।

ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর খাদ্য ও অন্যান্য চাহিদা মিটাতে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ বাড়ছে। তাই ভূগর্ভস্থ অধিক পানি উত্তোলনের ফলে উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এক প্রতিবেদনে জানায়, ভূগর্ভস্থ পানির উৎস দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। তাদের তথ্যমতে, বিশ্বের ৬৬ কোটি ৩০ লাখ মানুষ পানযোগ্য পানির সুবিধা থেকে বঞ্চিত। মানসম্মত পানির সুবিধা থেকে বঞ্চিত রয়েছে আরো প্রায় ১৮০ কোটি মানুষ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পানি হবে ভবিষ্যৎ মানবজাতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। দেশে দেশে পানির স্বল্পতা ও আন্তঃরাষ্ট্রীয় বিবাদ ভয়াবহ বিশ্বযুদ্ধ ডেকে আনতে পারে। ফলে নিরাপদ সুপেয় পানি প্রাপ্তি হবে আগামী বিশ্বের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ।

জাতিসংঘের চলতি বছরের পানি উন্নয়ন প্রতিবেদন বলছে, বর্তমানে বিশ্বজুড়ে জনসংখ্যা বৃদ্ধি, খরা, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার অভাব দেখা যাচ্ছে। এ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে আগামী ২০৫০ সালে চরম পানি সংকটে পড়বেন বিশ্বের ৫০০ কোটি মানুষ। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগামী তিন দশক ধরে প্রতিবছর বিশ্বে পানির ব্যবহার ১ শতাংশ বাড়বে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পানি সরবরাহের প্রচলিত উৎস খাল ও বিল শুকিয়ে যাচ্ছে, ফলে বেড়ে যাবে ভূগর্ভস্থ পানির চাহিদা। বিশ্বের ৯৯ শতাংশ সুপেয় পানি আসে ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে। কৃষিকাজে ব্যবহৃত পানির এক-চতুর্থাংশই আর দৈনন্দিন কাজে ব্যবহৃত পানির অর্ধেকই আসে ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে। কিন্তু এর অব্যবস্থাপনার কারণে এই সরবরাহ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) তথ্য বলছে, ২০১৯ সালে বিশ্বজুড়ে খাদ্য নিরাপত্তাহীন মানুষের সংখ্যা ৩৪ কোটি ছাড়িয়েছে। অতিমারি, সংঘর্ষ, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণ ও জাতিগত সংঘাত এ সংকটকে আরো ত্বরান্বিত করছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তীব্র খরায় ধুঁকছে বিশ্বের অধিকাংশ দেশ। এতে যেমন জীবনযাত্রার মান নেমে গিয়েছে অসহনীয় পর্যায়ে, সৃষ্টি হয়েছে সুপেয় পানির অভাব। 

এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ইনস্টিটিউটে প্রকাশিত এক জার্নালে বলা হয়েছে, মানবদেহে ক্যান্সার সৃষ্টিকারি ‘ফরেভার কেমিক্যাল’ বায়ুমণ্ডলে এত বেশি মাত্রায় পাওয়া গেছে যে নতুন এক নির্দেশিকায় বৃষ্টির পানিকে এখন পান করার ক্ষেত্রে অনিরাপদ ঘোষণা করা হয়েছে। এর কারণে কোলেস্টেরেল বৃদ্ধি, লিভারের এনজাইমে পরিবর্তন, শিশু জন্মের সময় কম ওজন, শিশুদের দেহে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা কমে যাওয়া, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি সমস্যা ও ক্যান্সার দেখা দিতে পারে। এমনিতেই বিশ্বের অনেক দেশেই নিরাপদ পানির সংকট রয়েছে। সেসব দেশে সুপেয় পানির উৎস হিসেবে বৃষ্টির পানিকেই বিবেচনা করা হত। এখন সেই পানিকেও অনিরাপদ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। লেখক: সাংবাদিক ও পরিবেশকর্মী